Friday, January 1, 2021

সবটা গল্প নয় ( সপ্তম ও শেষ দৃশ্য)

সবটা গল্প নয় ( সপ্তম ও শেষ দৃশ্য)

... আরে অর্নব তুমি এখানে?

হঠাৎ সেদিন অর্নবের সাথে দেখা হয়ে গেল।  বহুদিন হয়ে গিয়েছিল, ওদের কারোরই কোনও খোঁজ রাখিনি, বলা ভাল আর কোনও সূত্র পাচ্ছিলাম না।  ইউটিউব থেকে অনিন্দিতা, মানে তিতলির খবর দেখেছিলাম, যে ও UPSC Clear করেছে।  ব্যাস, ওইটুকুই।  আমিও ভেবেছিলাম, ওদের নিয়ে আর লিখব না।  কিন্তু, সবটা তো  আর আমাদের হাতে থাকে না।

- হ্যাঁ দাদা, ছুটিতে বাড়ি এসেছিলাম, তাই মিষ্টি কিনতে এসেছি। দাদা, পূজো কেমন কাটল?
- এবারে আর পূজো কোথায় হল, শুধু তো নিয়মরক্ষা হল, করোনা তো সবই খেয়ে নিল।
- তা যা বলেছ।  ভালোই হল, তোমার সাথে দেখা হয়ে।  কিছু নেবে নাকি দাদা?
- হ্যাঁ, আমিও বিজয়ার জন্য টুকটাক মিষ্টি কিনতে এসেছি।  সকালে একবার নিয়ে গেছি, মেয়ের আবার মিহিদানা ভালো লাগে, সব খেয়ে নিয়েছে, তাই আবার খাবে, মেয়ের বায়না রাখতেই হয়। 
- হ্যাঁ, ছোটদের কথা না শোনা খুব চাপের, আমার দাদার মেয়েটা আছে, কিছু বললে না শুনে রক্ষা নেই। 

এবার আমার একটু ওর কথা জানার ইচ্ছে হল,
- তুমি কী এখনো BDO হিসেবে ওখানেই পোস্টেড আছো?
- না,  দাদা, সে অনেক গল্প, এখন ইসলামপুরে আছি DMDC হয়ে। 
- বা:, দারুন ব্যাপার। তো এবার বিয়েটা তো সেরে নিতেই পারো, না কি.... 
- সে দাদা এক লম্বা গল্প,

বলেই হাসতে লাগল।

- ঠিক আছে,  না হয় নাই-ই বললে... 
- চলো দাদা তোমায় আজ একটু সারপ্রাইজ দেই..
- কেমন?
- আমার সাথে আমাদের বাড়ি চলো।  অসুবিধা নেই তো?
- সে কি? কেন?
- না, মানে তোমার যেতে আপত্তি নেই তো? 
- না না,  তা কেন থাকবে? আসলে মেয়ে আবার যে আমার অপেক্ষায় থাকবে। 
- বেশিক্ষন লাগবে না, খুব বেশি হলে ����আধ ঘন্টা।
- আচ্ছা, চলো।

আমি বাইক নিয়েই গিয়েছিলাম, অর্নব ও একটা নতুন Avenger  নিয়ে এসেছে, দুজনে চললাম ওর বাড়ি। 

দিনটি ছিল একাদশী, পুজার প্যান্ডেলগুলো খাঁ খাঁ করছে। একটা বিষাদ তো কাজ করেই। 

মিনিট তিনেকের মধ্যেই ওদের বাড়ি এসে গেলাম। ছিমছাম দোতলা বাড়ি, সামনেই অনেকটা জায়গা নিয়ে বাগান রয়েছে, মাঝখান দিয়ে পথ চলে গেছে বেশ ছায়াঘেরা উঠোন,  মন ভালো করে দেওয়ার মত পরিবেশ।

উঠোনে বাইক দাঁড় করিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালাম।  অর্নব কলিং বেল বাজালো।

আমি এটার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না।  এটাকে সারপ্রাইজ বলব না, বরং বলব, গল্পের প্লট ঘেঁটে দেওয়া। 

দরজা খুলে দাঁড়িয়ে.....  তিতলি!!!!

আমি একবার অর্নবকে দেখছি, আবার তিতলিকে দেখছি, ওরা স্বাভাবিক হাসিমুখে, আর আমি গাল চুলকাচ্ছি, আমার হিসেব মিলছে না।  সম্বিৎ ফিরল অর্নবের ডাকে -
- ভিতরে আসো দাদা। 
- মনে আছে তিতলি, তোমাকে ফেসবুকে দেখিয়েছিলাম এই দাদা আমাদের নিয়ে লিখছে, আজ দেখা হয়ে গেল, তাই বাড়িতেই নিয়ে এলাম। 
- খুব ভাল করেছ, আমার সাথেও সুরক্ষায় কথা হয়েছিল। আমি চিনি তো।
রান্নাঘর থেকে তিতলি উত্তর দিচ্ছে।

অর্নব বলল, কী দাদা, হিসেব মিলছে না?
আমি হেসেই ফেললাম, বললাম-
- মেলানোর চেষ্টা করছি।
- সে তুমি পারবে, জানি। যেভাবে তুমি আমাদের সেই প্রথম থেকে লক্ষ্য করছ, জানি তুমি সব বুঝেই ফেলবে, তাই আজ তোমাকে প্লটের বাইরে নিয়ে এলাম। 
বলেই হাসতে লাগল।

একপ্লেট মিষ্টি ইত্যাদি সাজিয়ে তিতলি আমার সামনে নিয়ে এসেছে,
- আজ কিন্তু দাদা দুপুরে আমাদের বাড়ি খেয়ে যাবেন। 
- না না, তা হয় নাকি, মেয়ে আমার অপেক্ষা করছে, আমিও স্নান করিনি, ফোনটাও নিয়ে আসিনি। 
- সে না হয় জানিয়ে দিচ্ছি, না খেয়ে যেতে পারবেন না।  আর এগুলো কিন্তু সব খেতে হবে।
- তোমরাও সাথে আসো, একসাথেই খাই।

তিনজনেই হাল্কা কথাবার্তার সাথে খাচ্ছি, এমম সময় বছর তিনেকের একটি বাচ্চা পাশের ঘর থেকে, মা, মা, বলতে বলতে এঘরে আসল।  তিতলি ওকে পরম যত্নে কোলে তুলে নিল।  আমি বুঝলাম, বাচ্চাটি সায়ন্তন বসুর ছেলে, আর ওদের কথাবার্তা, মেলেমেশার ধরনে পরিষ্কার, ওরা একসাথে থাকে।

আমি বলেই ফেললাম, 
- তোমাদের একসাথে দেখে খুব ভাল লাগছে, কিন্তু..
- মনে প্রশ্ন আছে তাই তো?  তিতলি বলল। 
- থাকাটা কী অস্বাভাবিক, বলো? 
- তুমিই খুঁজে বের করো, দাদা। অর্নব বলল। 
- তোমাদের সাথে দেখা না হলে অন্য উপায়ে বের করতাম, কিন্তু দেখা হয়ে যখন হয়ে গেছে, আর কেন কষ্ট করি বল তো?
- অর্নব, গল্পটি তুমিই দাদাকে বলে দাও এবার। 

অর্নব বলতে শুরু করল,
- আমি এখান থেকে DMDC হয়ে ইসলামপুরে জয়েন করার মাস তিনেক পরে আমাদের SDO সাহেব বদলি হয়ে যান, তিনি ADM হয়ে চলে যান, আর সেখানে আসার খবর পাই এক ম্যাডাম আসছেন, IAS হয়ে First Posting।  নাম অনিন্দিতা রায়।  এই নামটা শুনেই মনের মধ্যে কেমন একটা করে উঠেছিল।  কিশোর বয়সের প্রথম ভালোবাসা, নামটাই একটা ভালোবাসা, মানুষ যেই হোক না কেন! 
- তখন তোমার মনে হয়নি, তোমার অনিন্দিতা হতে পারে। 
- আমার সব অনিন্দিতাকেই নিজের বলে মনে হত, কিন্তু আমার ওর সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ওর বিয়ের পরেই শেষ হয়ে যায়। আমি আর ওর খোঁজ রাখিনি, নিজের জন্য ভাবতে শুরু করেছিলাম।
-তারপর?
- ইসলামপুর অফিসে যেদিন তিতলি জয়েন করতে আসে, আমরা অনান্য যারা ছিলাম, সবাই রীতি অনুযায়ী  ওয়েলকাম করতে গিয়েছিলাম...
- আর গিয়ে দেখলে.. 
- আর গিয়ে দেখি তিতলি!! 
- মনে আনন্দ হল?
- না, আনন্দ হয় নি, রাগও হয়নি, আমি ওর সম্বন্ধে নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম, ঠিক যেভাবে অন্যান্যরা আচরন করেছে, আমিও তেমন আচরন করেছি, যেমনটা হয় আর কি, আর তিতলির থেকে SDOর আচরনই পেয়েছি। 
- তাহলে এগোলো কে?
- আমি তো জানতামই না যে ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে,,  আর যেহেতু ও আমার সিনিয়র, কাজের বাইরে আমি কোনও কথা বলতাম না। কিন্তু ওর চোখে মুখে আলাদা কিছু একটা লক্ষ্য করতাম, বুঝেও উপেক্ষা করতাম।  একদিন কিছু একটা কাজে ওর ঘরে যাই, ও একাই ছিল, ও আমাকে আমার ডাকনামে ডেকে বলে,
- কেমন আছিস পাবলো?
আমার ডাক নাম পাবলো, ও আমাকে এই নামেই ডাকত।
- কিছু বলবেন ম্যাডাম?
- আর কতদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখবি?
- সরি ম্যাডাম,
বলে বেড়িয়ে আসতে যাচ্ছিলাম,  ও ছুটে  এসে হাত ধরে বলে,
- একবার আমার নাম ধরে ডাকনা?  কতদিন তোর মুখে আমার নাম শুনিনি!

তিতলি বলল, তুমি কী বলেছিলে সেটা বলো এবার। 
- বলছি তো, এখন খুব আগ্রহ, না?

অর্নব আবার বলতে শুরু করল,
আমার প্রথম কথাই ছিল,
- তুই বিয়ে করবি অন্য কোথাও, আমাকে জানাতেই পারতি, তার জন্য কথাবার্তা বন্ধ করে দেওয়ার দরকার ছিল কী?  তুই তো জানতিস, তোকে ছাড়া আমি একমুহূর্ত বাঁচতে পারি না, সেই ক্ষমতা আমার ছিল না, কত কষ্ট করে নিজেকে নিজেই সামলেছি।  কেউ সাথ দেয় নি। বখে যাওয়া ছিলাম কিনা?  আমি কি কখনও তোকে কোনও বিষয়ে জোর করেছি? সব সময় আগলে রেখেছি, তুই যাতে পড়াশোনা করে বড় কিছু হতে পারিস, সেই চেষ্টা করে গেছি, বাবার কাছ থেকে হাতখরচের টাকা নিয়ে তোকে বই কিনে দিয়েছি। বলতে  পারবি, একদিনও তোকে কোনও কথায় কষ্ট দিয়েছি? তোকে ভালোবাসি বলে আমার বাবা মা-ও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসেছি, একা, সম্পূর্ন একা। 

- পাবলো, �প্লিস চুপ কর, আমি নিরুপায় ছিলাম।
- মিথ্যে কথা, আমি তোকে বিশ্বাস করি না।
- এত সহজে আমার থেকে বিশ্বাস চলে গেল? আগের কথা তোর কী কিচ্ছু মনে নেই?
- আমার সব মনে আছে, তুই ভুলে গেছিস।  আর এই পাবলো তোর সেই আগে পাবলো নেই।  আজ আর এত সহজে কিছু বিশ্বাস করে না।  আমার হাত ছেড়ে দে। 

তিতল সে মুহুর্তে অর্নবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে। 

এবার তিতলি বলে,
তুমিও তখন নিজেকে আর সামলে রাখতে পারনি, সেটাও বলো, শুধু আমার কথা বললেই হবে? 
- হ্যাঁ দাদা, ওনেক দিন পরে ওর ওভাবে হঠাৎ জড়িয়ে ধরা দেখে আমিও নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি, সেদিন দুজনাই একসাথে অনেকক্ষন কেঁদেছিলাম।  এভাবেই আমার পুরোনো তিতলিকে ফিরে পেলাম।

তারপরে ওর সাথে অফিসেই কথাবার্তা চলত,

- হ্যাঁ রে পাবলো, তোর মিসেস কি করে?
- কুমার আছি রে, পাগলী, কুমার।
- বলিস কী?
- হ্যাঁ, এবার করব, মা আর একা পারছে না সামলাতে। মা তো এখনো তোর কথা বলে, বলে যে, কীরে, যার জন্য বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরতি, পারলি তাকে ঘরে আনতে?
- তুই কী বললি?
- আমি আর কী বলব? মাথা নীচু করে থাকি। আর মা বলে,  ওই মেয়ে চলে যাওয়ায় তুই ভদ্র হয়েছিস। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিস।
- তাহলে আমাকে ক্রেডিট দিচ্ছিস?
- সরাসরি দিচ্ছি না, কিন্তু ঘুরিয়ে দিতেই হয়।
- আজ যদি কাকীমার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, রাগ করবে?
- না মনে হয়, আজ আর তোর ওপর রাগ নেই কারও।
- আমাকে বিয়ে করবি?
- মানে?
- মানে আমাকে বিয়ে করবি?
- তোর সেই সায়ন্তন বসু?
- প্রিপারেশন নেওয়ার সময় কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম, তার পছন্দ হয়নি, সারাদিন লেখাপড়া তার সহ্য হয়নি, আর আমারও একঘেয়ে সংসার সহ্য হয়নি। 
- এখন?
- আপাতত দুবছরের ছেলে নিয়ে একাই আছি। মিউচুয়াল ডিভোর্স।

তিতলি বলে,
- তারপরেই আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই। ততদিনে অফিসের সবাই জেনে গেছে আমাদের ব্যাপারটা। একবছর হল, আমরা একসাথে আছি আমাদের ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে। 
- আর এই বুঝি সেই ছোট্ট বাবু?  কেমন আছো বাবা? 

চলুন দাদা, এবার কিছু খেয়ে নেই।
- না গো, আজ উঠি, অন্য কোনওদিন আসব আবার, এতক্ষনে মেয়ে হয়ত কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। 

এরপর অর্নবের বাবা মায়ের সাথে দেখা করে ও বিজয়ের প্রনাম করে বিদায় নিলাম।

এমনটাও হয়, ভাবতে ভাবতে বাড়ি এলাম। 

(সমাপ্ত) 

Sunday, November 22, 2020

সবটা গল্প নয় ( ষষ্ঠ দৃশ্য) ==================

সবটা গল্প নয় ( ষষ্ঠ দৃশ্য) 
==================

পঞ্চম দৃশ্য পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিষয় গুলো এমন - অর্নব বিশ্বাস লেখাপড়া করে বিডিও হয়েছে, এখনও অবিবাহিত আর তার ভালোবাসার মানুষ তিতলি ওরফে অনিন্দিতা রায় বিয়ে করেছে সায়ন্তন বসু নামের একজন ডাক্তারকে। 
পড়াশোনায় খুব নিষ্ঠা থাকা ও জীবনে সফল হওয়ার চেষ্টায় থাকা মেয়ে তিতলি বিয়ের পরে সুরক্ষায় রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করছে। তার সফল হওয়ার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেছে। অপরদিকে, যার সফল হওয়ার কথাই ছিল না, সেই অর্নব, তিতলিকে হারিয়ে ভীষন ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়, আর কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার জোরে সে আজ সফল বিডিও। 

তাহলে কী তিতলি তার বাকি জীবন এক সাধারণ গৃহবধূ হয়েই থাকবে? রিসেপশনিস্ট এর কাজই কী তার গন্তব্য ছিল? সে যে খুব উচ্চাকাঙ্খী মেয়ে, আমি যে তার চোখে অন্য কিছু দেখে এসেছি। 

আমি অর্নব আর তিতলির কথা ভুলেই গেছিলাম। নিজের অফিসের কাজকর্ম আর লেখাপড়া,  গানবাজনা করেই সময় কেটে যাচ্ছিল। ওরা আমার মন থেকে মুছেই গিয়েছিল। 

কিন্তু কথা দিয়েছিলাম, যদি কোনও দিন তিতলির সাফল্যের গল্প জানতে পারি সেদিন এই গল্পের ষষ্ঠ দৃশ্য লিখে ফেলব। 

ষষ্ঠ দৃশ্য 
===============
===============

ঘটনার সূত্রপাত এভাবে। আমার বরাবর ইউটিউব দেখার অভ্যাস, বিশেষ করে Motivational Video, Success Story খুব দেখি। আর UPSC Topper দের Mock Interview,  তাদের Journey, Successful candidates দের interview এসব দেখা আমার প্রায় প্রতিদিনকার সাধারণ কাজে পরিনত হয়েছে। এভাবেই একদিন ভিডিও দেখতে দেখতে একটি Success Story সামনে আসে। 

কার স্টোরি, কিচ্ছু জানি না। অভ্যাসবশত দেখছি।  তো, সেই ভিডিওটি ছিল Dristi IAS Centre এর সফল candidate দের নিয়ে। অনুষ্ঠানের শুরুতে সঞ্চালক বলছেন - 

- প্রতিবছর আমাদের একাডেমি থেকে বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রী সফল হন। তারা সকলেই যে মেধাবী, তা নয়, কিন্তু পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তারা সফল হওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন, আর নিজের একশ ভাগ উজার করে দিয়েছেন, তাই তারা সফল।   অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু আজ আমি তোমাদের সামনে এমন একজনকে নিয়ে আসতে চলেছি, যে একই সাথে মেধাবী,  পরিশ্রমী, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ,  যার নিষ্ঠায় কোনও ত্রুটি নেই, যে তার ব্যক্তিগত জীবনের সব বাধা দূরে সরিয়ে আজ সফল, শুধু সফল নয়, তার All India Ranking 4. 

আমার দেখার আগ্রহ বেড়ে গেল। 
সঞ্চালক বলে গেলেন - 
- যিনি তার সাত মাসের প্রেগন্যান্সি নিয়ে মেন পরীক্ষা দিয়েছেন, আর একমাসের সন্তানকে নিয়ে Interview দিয়েছেন। 

আমি অবাক হয়ে গেলাম। এমন স্টোরি তো শুনিনি। আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। সেই মেয়েকে দেখার জন্য একবার ভিডিওটি skip করতে ইচ্ছে হল, কিন্তু কথাগুলো শোনার জন্য অপেক্ষা করলাম। 

তিনি বলে চললেন - 
- তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন,  ইচ্ছেশক্তির থেকে বড় কোনও শক্তি নেই। আমারা একাডেমির সকল সদস্য তাকে কুর্নিশ জানাই। প্লিজ, মঞ্চে আসবেন  মিস অনিন্দিতা রায়।  

আমার একটু খটকা লাগল, বলছে সন্তান নিয়ে পরীক্ষা দিল, আবার বলছে মিস।  যাইহোক, আমি শুনতে থাকলাম। 

আগেই বলেছি, আমি তিতলির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। নামটি শোনার পরেই বড় বড় চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি। এভাবে ওকে খুঁজে পাব, স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার গল্পের নায়িকা যে এভাবে সাফল্য হাসিল করবে, এ আমার কল্পনার অতীত। ওর জয় যেন আমারই জয়। মুহূর্তে ছ বছর আগের সেই ট্রেনে পড়তে দেখা মেয়েটির মুখ, তার চালচলন,  তার লুকিয়ে রাখা প্রেম, কাঠিন্য সব ভেসে উঠলো।  তাহলে কিছুই বৃথা যায়নি, কিছুই বৃথা যায় না আসলে? মনে হচ্ছিল যেন আমারই পরিবারের কেউ যুদ্ধে জয়ী হল। 

আবার সন্দেহ হল, এ কি আমার গল্পের তিতলি না অন্য কেউ!  
মঞ্চে যে এল, তার পরনে হাল্কা নীল শাড়ি, পিঠে ছোট খোলা চুল, চোখে রিমলেস চশমা,  বাঁ হাতে ব্রাউন বেল্টের ঘড়ি, ডান হাতে একটি বালা, গলায় সরু চেন, কানে ছোট দুল। মুখে প্রশান্তি।  ধীর অথচ দৃঢ় পায়ে মঞ্চের মাঝে দাঁড়ালো। সঞ্চালক মাইক এগিয়ে দিলেন। 

হ্যাঁ, এ সেই আমার গল্পের তিতলি।  আমাদের গ্রামের তিতলি। 

ও যা বক্তব্য রাখল, সবটাই ইংরেজিতে,বাংলা করলে এমন দাঁড়ায় - 

- আমার একাডেমির সকল স্যার, ম্যাডামকে আমার প্রনাম, ভালবাসা জানাই, তারা পাশে না থাকলে এই সাফল্য কখনোই পাওয়া সম্ভব হত না। আমি জানি,  আমার জার্নি একটু আলাদা ছিল। তার জন্য আমি আমার পরিবারের সদস্য মানে আমার মা, বাবা, ছোট বোন ও ভাইকে আলাদা করে ধন্যবাদ দেব, ওরা পাশে না দাঁড়ালে আজ তোমাদের সামনে কথা বলার সুযোগ হত না। তবে আমি আমার লড়াই নিয়ে কিছুই বলতে চাই না। আসলে আমাদের সবাইকেই লড়তে হয়,  শুধু লড়াইয়ের ধরন ভিন্ন ভিন্ন। শুধু এটুকুই বলব, কখনো মনে করবে না, আমিই সবথেকে বড় প্রব্লেমের মধ্যে আছি, সেটা তোমাকে শুধুই পিছন দিকে নিয়ে যাবে। যে অবস্থাতেই থাকো না কেন, লক্ষ্যে পৌঁছাতে যা যা করা দরকার, সেই কাজটি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে করে যেতে হবে। বাকী সব কিছুকে পাশ কাটাতে হবে। সব মানে,  স....ব। সাফল্য তবেই আসবে। 

আমার মনে আবার প্রশ্ন, স্বামীর কথা তো কিছু বলছে না। তবে কী..... ,  দেখি পরে কী বলে!  

আবার বলছে -
ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যা আসতেই পারে, সেগুলো পাশ কাটিয়ে চলা অভ্যাস করে ফেলতে হবে। তুমি তোমার শরীরে তোমার সমস্যা বহন করে বেড়াতে পারবে না। কেউ তার মূল্য দেবে না। সিমপ্যাথি পেয়ে বড় কিছু করা যায় না, সেটা আশাও করবে না। বিশ্বাস রাখো নিজের উপর, পরিশ্রমের উপর, সততার উপর। নিরলস ভাবে, সঠিক পথে পরিশ্রম করার মানসিকতা গড়ে তোল। আমাদের স্যারেরা রয়েছেন তোমাদের জন্য। আমি বড় কিছু করে ফেলিনি, অবিশ্বাস্য কিছু করে ফেলিনি, আমি জিনিয়াস নই, আমি আলাদা কোনও প্রানী নই। আজ আমি যেটা পেরেছি, কাল তোমরাও সেটা পারবে। আগামী দিনে তোমরাও অন্যদের মোটিভেট করবে, স্টেজে বক্তব্য রাখবে। আমি তোমাদের থেকে একটি কথা নিয়ে যেতে চাই, আমাকে কথা দাও, তোমরা সবাই UPSC Clear করবে। 

সমবেত সবাই চিৎকার করব জানায় - 
ইয়েস,  ম্যাম। উই প্রমিস ইউ। 
-  Thank you.  

এই বলে স্টেজ ছেড়ে দেয়। অনুষ্ঠান চলতে থাকে। আমার আর দেখার ইচ্ছে হয় না। আমি আবার সার্চ করতে শুরু করি, অনিন্দিতা রায়ের অন্যান্য interview পাওয়া যায় কিনা।।যাতে জানতে পারি, তার বর্তমান সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক অবস্থান, এমমকি তার পোস্টিং কোথায় হল। আমাকে জানতেই হবে। গল্পের প্রয়োজনেই আমাকে জানতে হবে। 

আপাতত জানতে পারলাম তিতলি UPSC Clear করেছে, কোন পোস্টে আছে আর কোথায় পোস্টিং, আর ওর রিসেপশনিস্ট থেকে IAS হওয়ার জার্নি জানতে পারলে এই গল্পের সপ্তম দৃশ্যটি লিখে ফেলব। এবার অনির্বান কেও আর একবার খুঁজে বের করতে হবে। 

শুভরাত্রি।

Wednesday, March 11, 2020

কথোপকথন – ২

কথোপকথন – ২ 
....................................

আজ সকালে এক আত্মীয়াকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার বিষয় ছিল, সে যাবে জিয়াগাঞ্জ আর আমি যাব ব্যারাকপুর। ঠিক করেছিলাম অফিস যাওয়ার পথে একই ট্রেনে যাব, সে কালীনারায়নপুরে নেমে যাবে আর আমি সোজা চলে যাব ব্যারাকপুর, কিন্তু বাধ সাধল আমার তিন বছরের মেয়ে। সে বলে বসল, 
- বাবা, আমিও তোমার সাথে যাব। 
কান্নাকাটির ঝামেলা না করার জন্য আমি বললাম ঠিক আছে, তাই হবে, তুমিও যাবে। যথারীতি আমরা তিনজন বাইকে যাত্রা করলাম। বুঝে গেলাম আজ আর সঠিক সময়ে অফিস যাওয়া হচ্ছে না, চারদিন পরে অফিস খুলল, তাও আবার লেট। যাইহোক, সেই আত্মীয়াকে ট্রেনে তুলে দিয়ে দিলাম।  

গল্পটি এবার শুরু। প্লাটফর্ম দিয়ে হাঁটছিলাম, আমি আর মেয়ে, একটি ট্রেনের টিকিট পড়ে ছিল। লোকের পায়ে পায়ে নোংরা হয়েছে। মেয়ে বলল, 
- বাবা, এটা কী পড়ে আছে? 
- টিকিট পড়ে আছে মা। 
- কারা ফেলেছে বাবা?
- লোকেরা । 
- কোন লোকেরা বাবা?
- ঐ যারা ট্রেনে করে এখান থেকে কোথাও যায়, বা অন্য কোথাও থেকে ট্রেনে করে এখানে এসেছে, তারা। 

এবার একটু অন্যরকম প্রশ্ন, 
- লোকেরা টিকিট ভালোবাসে না, বাবা ? 
খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলাম, 
- হ্যাঁ, মা, বাসে তো, বাসবে না কেন? 
- তাহলে ফেলে দিয়েছে কেন? 
- আর দরকার নেই বলে। 
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। 
- দরকার না থাকলে কি ভালোবাসতে হয় না, বাবা ? 

একটু চুপ থাকলাম, বললাম, 
- হ্যাঁ, মা, দরকার না থাকলেও ভালবাসা যায়, ভালবাসতে হয়। 
ছোট্ট মানুষের সহজ প্রশ্ন, 
- তাহলে লোকেরা ওগুলো ফেলে দিল কেন? 
- ওগুলোর আর প্রয়োজন নেই মা, ওদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। 
- প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ভালোবাসতে হয় না? 
- হ্যাঁ, মা, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও ভালোবাসতে হয়।  যত্ন করতে হয়। 
ছোট্ট মানুষটি কী বুঝলো, কে জানে, সে বলল, 

- ও, তাই? 
- হ্যাঁ, তাই, মা আমার। 
আমরা প্লাটফর্ম পার করে গ্যরেজে চলে এসেছি। বাইকে মেয়েকে বসিয়ে বললাম, তুমি কিছু খাবে মা, 
- না, বাবা, বাড়ি চল, আমি তোমার সাথে স্নান করব। 

বাইক ছুটছে, মেয়ে আয়নায় মুখ দেখছে, আমার মাথায় প্রশ্ন ঘুরছে, আমরা কি সত্যিই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও  ভালোবাসতে পারি? দরকার মিটে গেলেও ভালোবাসতে পারি? নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। না, আমিও পারি না, পারি নি,আমার তরফ থেকেও অনেক অবহেলা আছে, যত্নের অভাব আছে, কিছুটা নিজের জগত তৈরি করে সেটাতেই নিজেকে আবদ্ধ রেখে ভাল থাকার চেষ্টা আছে। আমার কাছে এগুলো ভুল বলে মনে হলেও এই অভ্যাস থেকে বেরোতে পারি না। ভয় হয়, না জানি সম্পর্ককে যত্ন নিতে গিয়ে বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি ভেবে না বসে, আবার বুঝি কোনও দরকারে এসেছে। তার চেয়ে এই বেশ ভাল আছি। ভালোবাসাটি মনেই থাকুক সসম্মানে। 

আচ্ছা, আমাদের জীবনে কী সবটা কি দরকার আর প্রয়োজন ভিত্তিক? না , নিশ্চয়ই। ছোটবেলায় পিসি বাড়ি, মাসি বাড়ি, কাকা বাড়ি যেতাম,সকলেই গেছে,  নেহাত ঘুরতে, আনন্দ করতে, কোনও দরকার ছিল না, ভালোবাসা আর আদরের বিনিময়টাই সব ছিল। আর আজ বড় হয়ে সেই একই জায়গায় দরকার ছাড়া বা কোনও আমন্ত্রন ছাড়া যাওয়া হয় না। অনেক সময় আমন্ত্রনেও যাওয়া হয় না। বিপরীত দিকের অবস্থাও একই। এটাকে অবহেলা ছাড়া কী বলব? আবার এটাও ঠিক, যে সময়ের সাথে সাথে মুখের বদল হয়, নতুন কেউ অনেকখানি জায়গা পায়, প্রায়োরিটি বদলে যায়। আর কিছু পুরোনো সম্পর্ক অজ্ঞাতবাসে চলে যায়। 

 যাদের সাথে মেলামেশা, তারাও যত্ন করতে পারেনি, পারে না, সবই ক্ষণস্থায়ী বলে মনে হয়। প্রতিটি সম্পর্ককে যতটা যত্ন করা দরকার, পরিচর্যা করা দরকার, আমরা অধিকাংশই সেটা করতে পারি না, হয়ত করিও না । আর পরিচর্যার অভাবে প্রতিটি সম্পর্কই নিয়মরক্ষার উষ্ণতাবিহীন সম্পর্কে পরিনত হয়। ঠিক যেন, প্রয়োজনের তাগিদেই কিছু মানুষের একত্রিত হওয়া, সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া, কিছুকাল একসাথে অতিবাহিত করা, আবার যার যার পথ ধরে একাকীত্বের পথে পা বাড়ানো। বড়ই গোলমেলে গো, বড়ই গোলমেলে। 

অনেক বেশি বকে ফেললাম। আর, কাজ না থাকলে যা হয় আর কী! মাথার মধ্যে কত কিছু যে কিলবিল করে বেড়ায়। এতটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ দিতেই হবে, কেননা আমাদের মন এতটা সময় একজায়গায় আজকাল আর দাঁড়ায় না। ধন্যবাদ আর শুভ্রাত্রি।

Sunday, March 8, 2020

উদযাপন বিতর্ক

উদযাপন বিতর্ক
............................
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই কিছু বলতে যাচ্ছি। গত কয়েকদিন সোশ্যাল মিডিয়াতে  যা নিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সেই বিকৃত চর্চা, বিকৃত প্রকাশ, বিকৃত আনন্দ আর বিকৃত উদযাপন। আবার এই বিকৃত শব্দটি নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়, তুমি কে হে বিকৃত বলার? ঠিক কতটুকু নিয়ম ভাঙলে তাকে বিকৃত বলা যায়? এই বিকৃতির সীমারেখাই বা কে নির্ধারণ করবে? স্কুল কলজে পড়া হাজার হাজার শিক্ষিত (?) ছেলেমেয়ে যখন সমবেত ভাবে এই বিকৃতিকেই আনন্দ করে উদযাপন করছে, তখন তাদের মানসিকতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বৈকি। আবার সাথে সাথে এর পাল্টা প্রশ্নও ওঠে, এগুলো ঠিক করার আপনি কে? আমার আনন্দের প্রকাশ কিভাবে হবে, সেটি ঠিক করার আপনি কে? আমার শরীরে আমি কোন শব্দ লিখব, সেটি কি আপনি ঠিক করবেন? সত্যিই তো, আমরা কারা। তাহলে কে প্রশ্ন করবে?  আর যখন বৃহত্তর অংশ সংগঠিত ভাবে ভুল বিষয় উপস্থাপন করে, নিজেদের অসহায়তা সেখানে প্রকট হয়ে পড়ে। কেউ আবার ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্ন তুললে গোলকধাঁধায়  পড়তে হয়। সমস্ত বিষয় তর্কসাপেক্ষ।
কিন্তু বারে বারে কবিগুরুর গান বিকৃত হচ্ছে কেন? যিনি প্রথমবার গানটির মাঝে কিছু গালাগালি যুক্ত করে গেয়েছেন, তিনি অবশ্যই দোষী। তার অনেক ফলোয়ার, তাকে অনেকে সমর্থন করেন । তাকে অনেকে গালাগালি করেন, কেউ বা বলেন তাকে বোঝা নিম্ন বা মধ্যমেধার কাজ নয়। তিনি নাকি সমাজকে নতুন করে প্রতিবাদ করার পথ দেখাচ্ছেন। নতুন ভাষা , নতুন শব্দ, নতুন ভঙ্গী সৃষ্টি করছেন। সত্যিই কি তাই? হবে হয়ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বসন্ত উৎসব ঘিরে যে ছবিগুলো সামনে এসেছে, বেশীরভাগ মানুষই তাকে সহজভাবে গ্রহন করতে পারেননি।  না পারারই কথা। আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাসে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসবাস করেন, তার গানের কথার বিকৃতি সহ্য করা সত্যিই কঠিন। আর পাঁচজন কবি-লেখকের সাথে আমরা তাকে একাসনে রাখি না, তিনি স্বকীয়, স্বতন্ত্র। তাই ২৫ শে বৈশাখ, ২২ শে শ্রাবণ আলাদা অনুভূতিতে উদযাপিত হয়। এর ঠিক বিপরীতেও একদল আমরা আছি, যারা মনে করছি, স্বয়ং ভগবানের যখন বিকৃতি হয়, তাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাদ যাবেন কেন? ওনার লেখা কি কারও বাপের সম্পত্তি? আমাদের বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার তুমি কে হে? যেমন ভাবে খুশি গাইব, যে শব্দ আমার পছন্দ হবে সেই শব্দ বসিয়ে গাইব। বেশ, তাই হোক তবে। কিন্তু যেমন খুশি সুর আর যেমন খুশি শব্দ নিয়ে কিছু মৌলিক সৃষ্টির চেষ্টা হলে বেশী ভাল হয় না কি? অন্তত মস্তিষ্কের ভাল ব্যায়াম আর পুষ্টির যোগান হত। কিছু আমাদের এমনও মনে হয়েছে, যারা আজ গান বিকৃতি করেছে, তারাই হয়ত বড় হয়ে রবীন্দ্র-গবেষক হবে, গলা ভারী করে গান-বক্তৃতা করে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রথম সারিতে থাকবে। খুব স্বাভাবিক। আজ আমরা যারা গেল গেল রব তুলছি, তারাই স্কুল কলেজ জীবনে কত না মজার গান বানিয়েছি, তাতে খারাপ শব্দও ছিল। ক্লাসে বেঞ্চ বাজিয়ে গেয়েওছি। তখন সেটার প্রকাশ ছিল না, প্রচার ছিল না, বন্ধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর নিজেদের কাছেও সেগুলো কখনও অশ্লীল বলে মনে হত না, বরং সেগুলো ছিল এক ধরনের গোপন আনন্দ। মজার বিষয়। আর আজকে সবাই সবার এই মজার বিষয়টিকেই নেটের জন্য জেনে যাচ্ছি আর প্রতিক্রিয়ার বহর বাড়ছে। আর যারা এগুলো করছে, তারাও যে খুব সিরিয়াসলি এগুলো নিয়ে ভেবেছে, তা মনে হয় নয়। তবে আমরা দায়িত্বশীলতা আশা করতেই পারি। তাই নয় কি?
সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছে বসন্ত উৎসবের উদ্যোক্তা রা। তাদের উৎসবের আয়োজনের কমতি ছিল না, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট খুব ভাল পারফর্ম করেছে, অনেক মানুষ প্রশংসা করেছে, কিন্তু সেগুলো কিছুই সেভাবে সাধারন লোকের সামনে আসেনি। একটি ঘটনাকে সামনে রেখে সবকিছুই চাপা পড়ে গেছে। সত্যিই দুঃখজনক।  
এর সাথে ঝড় বয়ে গেল, মালদার চার স্কুল ছাত্রীর আরও হাই ভোল্টেজ ( যদি গালাগালির শ্রেনীবিন্যাস করা হয় ) বিকৃত শব্দের মিশ্রনে গান গাওয়াকে কেন্দ্র করে। এই ঘটনাতেও আমাদের বেশীরভাগ মানুষই নিন্দায় মুখরিত হয়েছে। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এই ভাবে বা এর থেকেও খারাপ ভাবে যে গান গাওয়া হয় না, তা কিন্তু নয়, সমস্যা প্রকাশ করাতে, মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়াতে সৃষ্টি হয়েছে। না জানি এমন কত গান, কত ভাবে প্রতিদিন রেকর্ড হচ্ছে। এটাও হয়ত নিছক মজা করার জন্যই ছিল। এক্ষেত্রেও আমরা একটু দায়িত্বশীলতা, পরিনত মনস্কতা আশা করতে পারি। তারা নেহাত শিশু নয়। আবার আমাদের মধ্যেই কিছু মানুষ বলেছি, এখন মজা করবে না তো, কখন করবে? ওরা যে শব্দে গান গেয়েছে, ওদের মুখে খুব ভাল মানাচ্ছে, লাইফটাকে এনজয় করছে, যারা খুব ভাল হয়, তাদের আর কিছু করা বা হয়ে ওঠা হয় না, এমন আরও কত কথা। ওদেরকে আমরা অনেকে সমর্থনও করেছি। তারা ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কেউ বলেছি, ওরা ভুল করেছে কিন্তু অন্যায় করেনি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা যারা বড়, যারা পিতা মাতা হয়েছি, তারাও আজ বহু ধারায় বিভক্ত। এই ঘটনাগুলো কি একটু হলেও ভাবায় না?
এই সবের মাঝে কিছু আমরা আছি, যারা নির্বিকার শ্রেণীর, সকাল থেকে সন্ধ্যা পয়সার জন্য কাজ করি, সংসার চালাই, ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা শেখাই, ঘুমিয়ে উঠে আবার কাজে যাই। কে রবীন্দ্রনাথ, কার গান কে গাইল, কে কোন শব্দ দিয়ে গাইল, কিচ্ছু লেনা দেনা নেই। কী ফেসবুক, কী হোয়াটস অ্যাপ, কার ভুলে সমাজ সংস্কৃতি গোল্লায় যাচ্ছে, আদৌ কোথাও যাচ্ছে না থেমে আছে, বসন্ত উৎসব আবার কারে কয়, চাঁদ কোথায় উঠেছিল, ফেসবুক স্ট্যাটাস কারে কয়, বড় বড় বাতেলা দেওয়া কাকে বলে, কোন বাড়ির মেয়ে কোথায় কিভাবে নাচলো, ভাড়মে যা। প্রতিবাদ?  সেটা আবার কী বস? ভোর চারটেয় উঠে কাজে না গেলে ভাত জুটবে না। ওসব ফেসবুকের প্রতিবাদ নিয়ে তোরাই থাক বস।
(কিছু কথা খারাপ ভাবে লিখে বাকস্বাধীনতা চর্চা করা হল)
জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে যে মানুষগুলো হিমসিম খায়, তাদের একবার জিজ্ঞেস করে দেখো তো কেউ, চাঁদ না উঠলেও তাদের কিছু যায় আসে কিনা ! জিজ্ঞেস কোরো তো, বসন্ত উৎসব মানে কী? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে। জাস্ট ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে। তাই লড়াইটা জীবিকার জন্য হোক, বেঁচে থাকার শর্ত পূরনের জন্য হোক, আর প্রতিবাদটা অন্যায় আর অসাম্যের বিরূদ্ধে হোক।



Sunday, February 16, 2020

সবটা গল্প নয় (বাকি অংশ) পঞ্চম দৃশ্য

সবটা গল্প নয় ( বাকি অংশ) 

.............................

কথা ছিল যদি কখনও মেয়েটির সন্ধান পাই, সেদিন পঞ্চম দৃশ্যটি লিখে ফেলব। আজ সেটি লিখে ফেলার সময় এসেছে। যে মেয়েটিকে শুধুমাত্র বিবাহিতা অবস্থায় ট্রেনে দেখেছিলাম, যার নাম, ঠিকানা কিছুই জানতাম না, তার খোঁজ পাওয়া মোটেই সহজ ছিল না। তার সন্ধান কিভাবে পেলাম, শুধু সেটি নিয়েই আরেকটি গল্প লেখা যায়। 
ছুটির দিনে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফেসবুক দেখছিলাম, অনেকগুলো ফ্রেন্ড সাজেশন ঘুরছিল। স্ক্রোল করে দেখতে দেখতে একটি মেয়ের ছবিতে চোখ আটকে যায়, না, সে আমার গল্পের মেয়ে নয়, অন্য মেয়ে, তার সাথে আমার দশটি কমন ফ্রেন্ড আছে। আমি তার প্রোফাইল খুলি, স্বাভাবিক আগ্রহবশেই খুলি শুধুমাত্র দেখার জন্যই। কিছু খোঁজার মন নিয়ে খুলিনি। সেই মেয়েটিরও বাড়ি হবিবপুর। মেয়েটির ফটো সেকশন খুলে দেখতে দেখতে অনেক পিছনের দিনে চলে যাই, প্রায় পাঁচ ছ বছর পিছনে চলে যাই। সেখানে রানাঘাট কলেজের সরস্বতী পূজার সময় মেয়েটির কিছু গ্রুপ ছবি দেখতে পাই, মেয়েদের গ্রুপ, প্রায় দশ –বারো জনের গ্রুপ। সেই ছবি জুম করে দেখতে থাকি। 

অবাক কান্ড। সেই গ্রুপে আমার গল্পের মেয়েটিকে দেখা যায় হলুদ শাড়িতে, খুব সাধাসিধে ভাবে, সবার থেকে আলাদা মুডে। আর সবাই যেমন ছবি তোলার সময় মুখ বাঁকিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে, কেউ বা জিভ বের করে, কেউ বা চোখ বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমার গল্পের মেয়েটি সেখানে নিছক বেমানান হয়ে ভদ্র ভাবে হাল্কা হাসিতে দাঁড়িয়ে আছে। আজকালকার এই ধরনের চোখ মুখ বাঁকানো মেয়েদের দুষ্টু ছেলেরা পোলিও খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমারও যে মনে হয়না, সেটা বলছি না, তবে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করেছি। না হলে হয়ত, অনধিকার চর্চা বা মানবাধিকার লঙ্ঘন করার দায় নিতে হবে। যাক সে কথা। 
আমি সেই ছবির স্ক্রীনশট নিয়ে রাখি আর আমার মিসেস কে দেখাই। কেননা, সেও হবিবপুরের মেয়ে, সেও ২০১৩ তে এম.এ. পাশ করেছে, কল্যানীতে পড়েছে, এলাকার মেয়ে হিসেবে হয়ত চিনতে পারবে, এই আশায় তাকে ছবিটি দেখাই। মিসেস তিন চারজন মেয়েকে চিনতে পারল। আমার আগ্রহ, আমার গল্পের মেয়েটিকে নিয়ে, না, সে তাকে চিনতে পারল না, বলল, মাঝে মাঝে হয়ত বা দেখেছে, কিন্তু ঠিক গল্পের মেয়েটির পাশের মেয়েটিকে চিনতে পারল। আমি বললাম, 
- পাশের মেয়েটিকে চিনতে পারছ?
- হ্যাঁ, এই মেয়েটিকে চিনি।
- হবিবপুরে থাকে?
- হ্যাঁ গো, তুমি যে কাকুর থেকে ওষুধ আনো, ওই যে বাজারে দোকান, সেই কাকুর ছোট মেয়ে। 
- তোমার সাথে পড়ত?
- না, ও আমার থেকে ছোট, ওর দিদি আমার সাথে পড়ত।
- আর এই মেটিকে চিনছ না? এই যে হলুদ শাড়িতে? 
- দেখেছি মনে হচ্ছে, কিন্তু আমাদের এই দিকটায় থাকে না মনে হচ্ছে। তুমি ওই কাকুকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারো। 

দিন দুয়েক পরে আমি ওষুধ নিতে কাকুর দোকানে গেলাম। আমার সাথে ভাল পরিচয়, সবসময় তার কাছে যাই, কথায় কথায় বলেই ফেলি, 
- কাকু, তোমার মেয়েরা চাকরি-বাকরি কিছু পেল? 
একটু অবাক হল। আমার সাথে শুধু ওষুধ নিয়েই কথা হয়, আজ এই আচমকা প্রশ্নে তাকিয়ে রইল, কিছুক্ষন। 
- তোমার বড় মেয়ে আর আমার মিসেস স্বপ্না তো একসাথেই পড়ত শান্তিপুর কলেজে, তাই না? 
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে। আর চাকরির চেষ্টা করেনি। 
- আর ছোট জন?
- ও ইংলিশ এ এম.এ. করেছে, বি.এড. করছে। টিচার হওয়ার ইচ্ছে। 
- তোমার ছোট মেয়েকে আমি দেখেছি।
- হ্যাঁ, ও তো মাঝে মাঝে দোকানে বসে। 
- আমি দোকানে দেখিনি, তবে ফেসবুকে দেখেছি।
- ও আচ্ছা। 
বলেই আমি পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে ছবিটি দেখাই। 
- এই দেখো , কাকু।
- এ তো অনেক আগের, কলেজের মনে হচ্ছে। 
- হ্যাঁ, কাকু।
এবার আমার আসল উদ্দেশ্যে চলে এলাম। বলে ফেললাম, 
- আচ্ছা কাকু, এই হলুদ শাড়ি পরা মেয়েটিকে চেনো? 
- দেখি।। 
কাকু ভাল করে দেখলো। 
- হ্যাঁ, চিনি তো, আমাদের পাড়াতেই থাকে। আমার মেয়ের সাথেই পড়ত। ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে। 
- নাম কী কাকু, মেয়েটার? 
- আমরা তো ওকে তিতলি বলে ডাকি, খুব ভাল মেয়ে,ও, আমাদের বাড়িও আসত, তবে ওর একটা ভাল নামও আছে। ভুলে গেছি। 
- কোথায় বিয়ে হয়েছে কাকু?
- ওর বেলঘড়িয়ায় বিয়ে হয়েছে। 
ইতিমধ্যে কিছু কাস্টমার দোকানে এসেছে, আমাদের কথাবার্তা সাময়িক বন্ধ থাকল। আবার ফাঁকা পেলাম, 
- কাকু, ওর বর কী করে? 
- ওই মেডিক্যাল লাইনেই আছে। 
- ডাক্তার নাকি?
- না, ঠিক ডাক্তার না, আবার কম কিছুও না।
- মানে?
- টেকনিশিয়ান গোছের, তবে খুব উঁচু পোষ্টে কাজ করে। 
- তুমি কি জানো, কোথায় চাকরি করে? 
- যখন বিয়ে হয়, তখন খড়দায় সুরক্ষাতে চাকরি করত। ওরা তো  আবার ছেড়ে অন্য জায়গায় চলেও যায়, এখন কোথায় আছে জানি না। 
- বিয়ের পরে এখানে আসেনি?
- হ্যাঁ, দু একবার এসেছেও। পূজাতে এসেছিল তো। 
- ও আচ্ছা। 
- তা তুমি এই মেয়েটার কথা শুনছ কেন? চেনো নাকি? 
- না কাকু, চিনি না, তোমার মেয়ের সাথে দেখলাম, তাই জিজ্ঞেস করলাম। স্বপ্না ওর কথা বলছিল, বলল, তুমি হয়ত চিনবে, তাই আর কি। 
- ও। 
- আসি তাহলে কাকু। 

এই বলে চলে এলাম। মোটামুটি একটা ধারনা পেলাম। ডাকনাম পেলাম, শ্বশুরবাড়ির অবস্থান পেলাম, স্বামীর স্ট্যাটাস পেলাম। তবে এইটুকুই যথেষ্ট ছিল না। আমার জানার আগ্রহ ছিল, তিতলি ব্যক্তিগত জীবনে কোথায় গিয়ে পৌছল।একবার, তিতলির মুখোমুখি দাঁড়ানোর ইচ্ছে আছে। দেখা যাক, আমিও কোথায় গিয়ে থামি। 

ঘটনাক্রমে একদিন তিতলির মুখোমুখি দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাই। এবার আসব সেই ঘটনায়। 

দৃশ্য – ৫
.......................................

আমার বাবার বয়স হয়েছে, প্রায় ৭২ হবে, কোমরে সমস্যা, খুব ব্যথা, সেখান থেকে বাঁ পায়ে সমস্যা, দাঁড়াতে পারে না, হাঁটু আপনা আপনি ভেঙে বসে পরে। প্রথমে অর্থপেডিক দেখানো হল, নৈহাটিতে, তারপরে নিউরোসার্জন দেখানো হল, সেটাও নৈহাটিতেই। অনেক রকম টেস্ট, দীর্ঘদিনের চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপির পর বাবা মোটামুটি সুস্থ। সে সব বিস্তারিত কথায় যাচ্ছি না। কিন্তু এটুকুর সাথে আমার গল্পের যোগ আছে, তাই লিখতেই হল। 
অর্থোপেডিক ডাক্তার কোমরের এম.আর.আই. করতে দিয়েছিল আর সাথে খড়দাতে সুরক্ষায় যাওয়ার সুপারিশ করেছিল। যে সময়ের কথা বলছি, তখন নৈহাটিতে কোথাও এম.আর.আই. করানো হত না, কাছাকাছি ছিল কল্যানীতে, খরছ ছিল ছয় হাজার টাকা, কিন্তু ডাক্তারের সুপারিশে খড়দা থেকে করালে খরচ হবে আড়াই হাজার টাকা, তাই খড়দা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তখন বাবা হাঁটতে পারে না, আমি আর আমার মিসেস বাবাকে নিয়ে গাড়ি ভাড়া  করে সোজা খড়দা সুরক্ষা তে, যেখানে আমার জন্য অবাক হওয়ার পালা অপেক্ষা করছিল। সাথে কিছুটা বেদনা। 

সুরক্ষায় ঢুকেই বাঁ হাতে রিসেপশন, সেখানে তিনজন সুসজ্জিত, স্মার্ট, দক্ষ মহিলা কাজ সামলাচ্ছেন। আর তাদের মাঝে একটি মহিলা আমার গল্পের তিতলি।ও ঠিক মাঝে রয়েছে, আর ঘটনাক্রমে ওর কাছেই লাইন কম ছিল, আমি বাবা আর মিসেসকে বসিয়ে লাইনে দাঁড়াই, আমার লাইন আসে, আমি তিতলির মুখোমুখি, যার সাথে কখনও কথা বলনি, আজ তার সাথে প্রথম কথা। তার সেই আগের গাম্ভীর্য আবার ফিরে এসেছে, এবার যেন অনেক বেশি দায়িত্ববান, অনেক বেশি নিষ্ঠা। আমি লাইনে দাঁড়িয়ে তার গতিবিধি, নড়াচড়া, কথাবলা, তাকানো সবই লক্ষ্য করছিলাম কিন্তু সে নিজেকে এতটাই ঢেকে রেখেছিল তার গাম্ভীর্য দিয়ে, আমি ঠিক পড়তে পারছিলাম না। তার দু চোখ খুব মন দিয়ে দেখছিলাম, খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, সে কি এটাকেই তার শেষ গন্তব্য বলে মেনে নিয়েছে, নাকি আজও সেই কিছু করার জেদ কিছুটা অবশিষ্ট আছে। আমার মন বলছিল, সে এটাকেই তার গন্তব্য বলে মেনে নেয়নি, সেই মেয়ে শেষে একজন সাধারন রিসেপশনিস্ট হয়ে বাকি জীবন কাটাতে পারে না। আমার মন বলছিল, সে ভিতরে ভিতরে আজও নিজের সাথে লড়ছে। 

এইসব ভাবতে ভাবতেই আমি তিতলির গলার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেলাম।  
- আপনার বুকিং নাম্বার টি কত স্যার?
- ফরটি সিক্স ম্যাম।
- পেসেন্টের নাম?
- মহাদেব হালদার।
- বিলিং অ্যাড্রেস টি বলবেন প্লিজ। 

আমি সব কিছু বলে, ক্যাশ জমা করে দিলাম। সে বলল, 

- এম.আর.আই. ছিল, ফরটি ফোর ঢুকেছে, আপনারা প্লিস বসুন, আমরা অ্যানাউন্স করব। 
- থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম। 
এই বলে আমি বাবার পাশে গিয়ে বসি। আর অপেক্ষা করতে থাকি। বুঝে যাই অন্তত ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করতে হবে। কেননা একটা এম.আর.আই. করতে প্রায় আধ ঘন্টা সময় লাগেই। নিজের হাঁটুর এম.আর.আই. করার সময় প্রায় চল্লিশ মিনিট ঠান্ডা ঘরে  কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে থাকতে হয়েছিল। সেখান থেকেই সময়ের আন্দাজটি পেয়েছি। 

এখানে তিতলির দেখা পেয়ে আমি একসাথে অবাক, খুশি, আবার ব্যথিত। ওর বর্তমান পরিস্থিতি আমার ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছিল না। ওর সাথে  কথা বলার জন্য খুব আগ্রহী ছিলাম। 

ওকে একবার সিঁড়ি দিয়ে ওপড় তলায় যেতে দেখলাম, একটু ভারী হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে। আর একবার এম.আর.আই. রুমে গিয়ে কিছুক্ষন থেকে এল। ওর ফেরার পথে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, বলে ফেললাম, 
- এক্সকিউজ মি, ম্যাম।
- হ্যাঁ বলুন।
- আপনার সাথে দুটো কথা বলা যাবে? 
- হ্যাঁ, বলুন।
- আপনি কি ম্যাডাম, হবিবপুর থাকতেন? 
- হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
- না। আসলে আমিও হবিবপুর থাকি তো, তাই আর কি।
- কিন্তু আপনার বিলিং অ্যাড্রেস যে নৈহাটি দেখলাম!
- হ্যাঁ, ম্যাম, আসলে আমার নিজের বাড়ি নৈহাটিতেই, আর আমার মিসেসের বাড়ি হবিবপুরে। 
- ও আচ্ছা। 
এই বলে সে চলে যেতে উদ্যত হল। আমি জানি এই সুযোগ হয়ত আর পাবো না, তাই একনাগাড়ে বলে গেলাম,
- আমি ম্যাম অনেক আগে আপনাকে রানাঘাট স্টেশনে আর ট্রেনে বই পড়তে দেখতাম, সেখান থেকেই আপনাকে চিনি। 
মেয়েটি চলে যেতে গিয়েও থেমে গেল। এক মুহূর্তের জন্য চোখ  নামিয়ে নিল। মুখে হাল্কা মেকআপ করা থাকলেও মুখের বদলে যাওয়া রঙ আমার চোখে ধরা পড়ল। মুখের হাল্কা হাসিটিও মিলিয়ে গেল । সামলে নিয়ে বলল, 
- ও, আচ্ছা। সে তো অনেক দিন আগের কথা। 

- হ্যাঁ, ম্যাম, সেখান থেকেই চিনি। কিছু যদি মনে না করেন, আপনার নামটি জানতে পারি কি?

একটু ইতস্তত করেও বলল, 
- অনন্দিতা রায়। 
আমি মনে মনে হিসেব করে নিলাম, অর্ণব আর অনিন্দিতা, কী সুন্দর মিলত। আজ দুজন, কে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। 
- তাহলে ম্যাম, আপনি এখন এখানেই জব করছেন। 
- হ্যাঁ, এখানেই আছি। 
- আর গভমেন্ট জবের জন্য চেষ্টা করছেন না?
আবার সেই শক্ত চোয়াল। উত্তর এল, 
- না, আর করছি না। 
আমার মন অন্য কথা বলছিল, এ মেয়ে ছাড়েনি, চেষ্টা চলছে, কিন্তু প্রকাশ করছে না। নিশ্চয়ই অন্য কোনও গল্প সৃষ্টি হয়েছে। বললাম, 
- ও, আচ্ছা ম্যাম, আর ম্যাম আপনার হাসব্যান্ড? 
এই কথা বলায় সে আরও গম্ভীর হয়ে যায় আর বলে, 
- আপনি প্লিজ বসুন, কাউন্টারে লাইন পড়েছে। 
এই বলে চলে যায়। তার যাওয়ার পথেই বলি, 
- থ্যাঙ্ক ইউ, ম্যাম, আর আপনার সময় নষ্ট করার জন্য সরি। 
- প্লিজ, আপনি বসুন। 
সে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। আর কথা বলতে চায় না। আমিও গিয়ে বসলাম। কিন্তু ভেবে নিলাম, আরও কিছু জানব। যথা সময়ে বাবার ডাক আসল। আমি আর মিসেস গিয়ে রুমের সামনে দাঁড়ালাম, আমি বাবাকে নিয়ে রুমে গেলাম, খুব ঠান্ডা ঘর, এক সৌম্যদর্শন যুবক, বয়স আন্দাজ করি ৩৫ – ৩৬ হবে। যথেষ্ট উচ্চতা, ফর্সা, কোয়ালিফায়েড পার্সন, কম্পিউটারের সামনে বসে আছে, ডাক্তারের পোশাক, আমার দিকে তাকিয়ে বলল – 
- প্লিজ, সিট হেয়ার। 
আমি ওনার  থেকে একটু দূরে থাকা চেয়ারে বসলাম, সেই ঘরের মধ্যে দিয়ে আরেকটি কাঁচে ঘেরা ঘরে বাবাকে নিয়ে গেল একজন নার্স, প্রসেস শুরু হলে আমি বাইরে চলে আসি, বাইয়ে মিসেস অপেক্ষা করছিল। 
আমি আর মিসেস একটু হাঁটাচলা করতে লাগলাম আর মেয়েটির কথা বললাম ওকে। ও দূর থেকে মেয়েটিকে দেখল, আর বলল, এই তোমার গল্পের মেয়ে? তা কথা হল কিছু?
- হ্যাঁ, মোটামুটি হয়েছে, যাওয়ার আগে আবার একবার দেখা করার ইচ্ছে আছে। দেখি , কথা বলা যায় কিনা! 

বাবার টেস্ট হয়ে গেছে, এবার বাড়ি ফেরার পালা। সবে তিনজন উঠে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় মেয়েটি আবার কাউন্টার ছেড়ে বাইরে এসেছে।  আমি সামনে গিয়ে বললাম, 
- ম্যাম, আর একটি কথা! 

ডান হাত তুলে বলল, 
- প্লিজ, আর কোনও কথা নয়। ব্যস্ত আছি। 
এই বলে চলে যাচ্ছিল। আমি দূর থেকেই বললাম,
- ম্যাম, আপনি অর্ণব বিশ্বাস কে চেনেন? 
আন্দাজ ছিল, এই নামটি এড়িয়ে যাওয়া তিতলির পক্ষে সম্ভব হবে  না। ঘুরে দাঁড়ায়, বলে- 
- কী নাম বললেন আপনি? 
- অর্ণব বিশ্বাস।
- আপনি চেনেন তাকে?
- হ্যাঁ, আপনার সাথেই দেখেছিলাম। 
- আপনার সাথে কথা হয়েছে কখনও? 
- হ্যাঁ, বলেছি।
- কোথায় থাকে এখন?
- দমদমে ফ্ল্যাট নিয়েছে। 
- কী করছে এখন?
- বি.ডি.ও. 
- ওর কন্টাক্ট ডিটেলস আছে?
- না, নেই। 
তিতলি এই কথা গুলো একনাগাড়ে বলে গেল, ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে, ওর চোখে আগ্রহের ছাপ। কিছুটা যেন উতলা হয়েছে। চাপা ছিল বোধহয়। না হয় ইচ্ছে করে , না হয় বাধ্য হয়ে চেপে রেখেছে। আজ বুঝি আমি কিছুটা মুক্ত করার সুযোগ দিলাম। সামলে নিল নিজেকে দ্রুত। বলল, 
- ও আচ্ছা। 
বলে অপ্রস্তুত হেসে ফেলল। আমিও সুযোগ বুঝে জিগ্যেস করে ফেললাম, 
- আপনার হাসব্যান্ডের কথা জানা হল না, ম্যাম। 
এবার মেয়েটি কিছুটা পরিচিত মানুষের মত আচরণ করল। বলল, 
- এম.আর.আই. রুমে যাকে দেখলেন, তিনিই আমার হাসব্যান্ড। ডক্টর সায়ন্তন বোস। তার সুবাদেই এখানে চাকরি। একসাথে আসি আর একসাথেই বাড়ি ফিরি। 
আমার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছিল। বললাম, 
- এটা খুব ভালো ব্যাপার, ম্যাম। 
- তা ঠিক, বলে হাসল। 
- থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম, তাহলে আসি। 
- আর হ্যাঁ, আপনি কাল বিকেলেই রিপোর্ট পেয়ে যাবেন। 
- আচ্ছা ম্যাম। 
এই বলে সুরক্ষা ত্যাগ করলাম। 

একটি জানা সম্পূর্ন হল। মনে হচ্ছিল, এই গল্পের এখানেই শেষ নয়, তিতলির চোখ অন্য কথা বলছিল। ওর সেই জেদ, সংকল্প, দৃঢ়তা আমি দেখেছি, এই মেয়ে নিশ্চয়ই ওর স্বপ্ন পূরনের জন্য লড়ছে, হ্যাঁ, আজও লড়ছে। ও রিসেপশনিস্ট হয়ে জীবন কাটানোর মেয়ে নয়। 
যে প্রশ্নগুলোর আজও উত্তর পেলাম না, যেমন,  ও কেন বিয়ে করে নিল অন্য ছেলের সাথে, কেন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে প্রাইভেট জব করছে, অজানাই থেকে গেল। 

যদি কোনওদিন এই সব প্রশ্নের উত্তর পাই আর মেয়েটির সাফল্যের কথা কোনওভাবে জানতে পারি, সেদিন এই গল্পের ষষ্ঠ  দৃশ্যটি লিখে ফেলব।
......................................................

Saturday, February 15, 2020

ভ্যালেন্টাইন শুভেচ্ছা

ভ্যালেন্টাইন শুভেচ্ছা। 
=============

সদ্য কৈশোর পেরোনো যে ছেলেটা
পড়াশুনার ইতি টেনেছে সংসারের চাপে 
বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর আনন্দে 
ছেদ পড়েছে, টিউশানি বা পার্ট টাইম জবে, 
হাজার গিফট স্টোর পাশ কাটিয়ে 
ওষুধের দোকান খুঁজে ফেরে যে চোখ,
তারুন্যের উচ্ছ্বলতা ম্লান করে শূন্যতা 
ঠাঁই নিয়েছে যে দৃষ্টিতে,
শুভেচ্ছা রইল তার জন্য। 

সদ্য যুবতী হওয়া যে মেয়েটি 
প্রতিদিন সেলাইয়ের কাজে যায়, 
সূচবিদ্ধ যে আঙ্গুলে কেউ চুম্বন করে নি, 
যার শিরা ওঠা হাত কারো ভাল লাগেনি, 
যে হাত কোনও প্রেমিকের কাঁধে ভরসা পায়নি,
যে হাত পরম মমতায় স্পর্শ করেছে 
অসুস্থ বাবার কপাল, 
পরিশ্রমে জীর্ণ হওয়া যে শরীর
আলিঙ্গন পায়নি কোনও আশ্বাসের,
শুভেচ্ছা রইল তার জন্য। 

সংসারের চাপে যে মানুষের 
সূর্যোদয় দেখা হয় না, 
গুলিয়ে ফেলেছে যে আজকের তারিখ, 
মাঝ রাতে বাড়ি ফেরা যে পিতা 
ঠিক মনে করে আনে ছেলের ওষুধ, 
কাজ সেরে ক্লান্ত যে মা 
ঠিক ঢেকে রাখে ছেলের রাতের খাবার, 
শুভেচ্ছা রইল তার জন্য। 

রবীন্দ্র, 
১৪/০২/২০১৮।

Thursday, February 13, 2020

প্রনাম স্যার.....

প্রণাম নেবেন স্যার,  ভাল থাকবেন,  সুস্থ থাকবেন। 
আমাদের সময়ে স্কুলের সবথেকে ফিট, হ্যান্ডসাম আর স্টাইলিশ স্যার আপনি। সেজন্য আলাদা ভাল লাগা ছিলই। আর পড়ানোর সাথে মজাও চলত অনেক। কেমিস্ট্রির অনেক কিছু শিখেছি আপনার থেকে। ল্যাবে হাতে ধরে সবাইকে শিখিয়েছেন অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা।  HS এর ফাইনাল exam এ ল্যাবে আমাদের অনেককে সাহায্য করেছেন। ভাল নাম্বার দিয়েছেন। ভুলিনি কিছুই। 
আর আপনার আরও একটি ভাল লাগার জায়গা স্পোর্টস।  যারা খেলাধুলায় ভাল ছিল, তাদের আপনি খুব ভালবাসতেন, ডিটেলস খোঁজ খবর রাখতেন। কে কোন পজিশনে খেলে, সে সব জানতেন। আপনি নিজেও খেলতেন। আপনাকে ক্রিকেট,  ভলিবল খেলতে দেখেছি।
স্কুলের annual sports এ আপনার special performance থাকত। সাথে মনীন্দ্র স্যারের জাম্প। খুব ভাল লাগার সময় এগুলো। স্কুল ছেড়েছি ২০০০ সালে। মনে হয় এইত সেদিন।  
আপনার ব্যক্তিত্ব কে এমনিতেই শ্রদ্ধা করতাম। আলাদা করে কোনদিন বকা শুনিনি বা মারও খাইনি। 

আবার বলি, ভাল থাকবেন স্যার। সমৃদ্ধ হয়েছি আপনার আর আপনার মত আরও স্যারের সান্নিধ্য পেয়ে, আমি আর আরও হাজার হাজার ছাত্র। 

এ পাওয়া জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। 
প্রনাম নেবেন স্যার।🙏🙏🙏