সবটা গল্প নয় ( সপ্তম ও শেষ দৃশ্য)
... আরে অর্নব তুমি এখানে?
হঠাৎ সেদিন অর্নবের সাথে দেখা হয়ে গেল। বহুদিন হয়ে গিয়েছিল, ওদের কারোরই কোনও খোঁজ রাখিনি, বলা ভাল আর কোনও সূত্র পাচ্ছিলাম না। ইউটিউব থেকে অনিন্দিতা, মানে তিতলির খবর দেখেছিলাম, যে ও UPSC Clear করেছে। ব্যাস, ওইটুকুই। আমিও ভেবেছিলাম, ওদের নিয়ে আর লিখব না। কিন্তু, সবটা তো আর আমাদের হাতে থাকে না।
- হ্যাঁ দাদা, ছুটিতে বাড়ি এসেছিলাম, তাই মিষ্টি কিনতে এসেছি। দাদা, পূজো কেমন কাটল?
- এবারে আর পূজো কোথায় হল, শুধু তো নিয়মরক্ষা হল, করোনা তো সবই খেয়ে নিল।
- তা যা বলেছ। ভালোই হল, তোমার সাথে দেখা হয়ে। কিছু নেবে নাকি দাদা?
- হ্যাঁ, আমিও বিজয়ার জন্য টুকটাক মিষ্টি কিনতে এসেছি। সকালে একবার নিয়ে গেছি, মেয়ের আবার মিহিদানা ভালো লাগে, সব খেয়ে নিয়েছে, তাই আবার খাবে, মেয়ের বায়না রাখতেই হয়।
- হ্যাঁ, ছোটদের কথা না শোনা খুব চাপের, আমার দাদার মেয়েটা আছে, কিছু বললে না শুনে রক্ষা নেই।
এবার আমার একটু ওর কথা জানার ইচ্ছে হল,
- তুমি কী এখনো BDO হিসেবে ওখানেই পোস্টেড আছো?
- না, দাদা, সে অনেক গল্প, এখন ইসলামপুরে আছি DMDC হয়ে।
- বা:, দারুন ব্যাপার। তো এবার বিয়েটা তো সেরে নিতেই পারো, না কি....
- সে দাদা এক লম্বা গল্প,
বলেই হাসতে লাগল।
- ঠিক আছে, না হয় নাই-ই বললে...
- চলো দাদা তোমায় আজ একটু সারপ্রাইজ দেই..
- কেমন?
- আমার সাথে আমাদের বাড়ি চলো। অসুবিধা নেই তো?
- সে কি? কেন?
- না, মানে তোমার যেতে আপত্তি নেই তো?
- না না, তা কেন থাকবে? আসলে মেয়ে আবার যে আমার অপেক্ষায় থাকবে।
- বেশিক্ষন লাগবে না, খুব বেশি হলে ����আধ ঘন্টা।
- আচ্ছা, চলো।
আমি বাইক নিয়েই গিয়েছিলাম, অর্নব ও একটা নতুন Avenger নিয়ে এসেছে, দুজনে চললাম ওর বাড়ি।
দিনটি ছিল একাদশী, পুজার প্যান্ডেলগুলো খাঁ খাঁ করছে। একটা বিষাদ তো কাজ করেই।
মিনিট তিনেকের মধ্যেই ওদের বাড়ি এসে গেলাম। ছিমছাম দোতলা বাড়ি, সামনেই অনেকটা জায়গা নিয়ে বাগান রয়েছে, মাঝখান দিয়ে পথ চলে গেছে বেশ ছায়াঘেরা উঠোন, মন ভালো করে দেওয়ার মত পরিবেশ।
উঠোনে বাইক দাঁড় করিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালাম। অর্নব কলিং বেল বাজালো।
আমি এটার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না। এটাকে সারপ্রাইজ বলব না, বরং বলব, গল্পের প্লট ঘেঁটে দেওয়া।
দরজা খুলে দাঁড়িয়ে..... তিতলি!!!!
আমি একবার অর্নবকে দেখছি, আবার তিতলিকে দেখছি, ওরা স্বাভাবিক হাসিমুখে, আর আমি গাল চুলকাচ্ছি, আমার হিসেব মিলছে না। সম্বিৎ ফিরল অর্নবের ডাকে -
- ভিতরে আসো দাদা।
- মনে আছে তিতলি, তোমাকে ফেসবুকে দেখিয়েছিলাম এই দাদা আমাদের নিয়ে লিখছে, আজ দেখা হয়ে গেল, তাই বাড়িতেই নিয়ে এলাম।
- খুব ভাল করেছ, আমার সাথেও সুরক্ষায় কথা হয়েছিল। আমি চিনি তো।
রান্নাঘর থেকে তিতলি উত্তর দিচ্ছে।
অর্নব বলল, কী দাদা, হিসেব মিলছে না?
আমি হেসেই ফেললাম, বললাম-
- মেলানোর চেষ্টা করছি।
- সে তুমি পারবে, জানি। যেভাবে তুমি আমাদের সেই প্রথম থেকে লক্ষ্য করছ, জানি তুমি সব বুঝেই ফেলবে, তাই আজ তোমাকে প্লটের বাইরে নিয়ে এলাম।
বলেই হাসতে লাগল।
একপ্লেট মিষ্টি ইত্যাদি সাজিয়ে তিতলি আমার সামনে নিয়ে এসেছে,
- আজ কিন্তু দাদা দুপুরে আমাদের বাড়ি খেয়ে যাবেন।
- না না, তা হয় নাকি, মেয়ে আমার অপেক্ষা করছে, আমিও স্নান করিনি, ফোনটাও নিয়ে আসিনি।
- সে না হয় জানিয়ে দিচ্ছি, না খেয়ে যেতে পারবেন না। আর এগুলো কিন্তু সব খেতে হবে।
- তোমরাও সাথে আসো, একসাথেই খাই।
তিনজনেই হাল্কা কথাবার্তার সাথে খাচ্ছি, এমম সময় বছর তিনেকের একটি বাচ্চা পাশের ঘর থেকে, মা, মা, বলতে বলতে এঘরে আসল। তিতলি ওকে পরম যত্নে কোলে তুলে নিল। আমি বুঝলাম, বাচ্চাটি সায়ন্তন বসুর ছেলে, আর ওদের কথাবার্তা, মেলেমেশার ধরনে পরিষ্কার, ওরা একসাথে থাকে।
আমি বলেই ফেললাম,
- তোমাদের একসাথে দেখে খুব ভাল লাগছে, কিন্তু..
- মনে প্রশ্ন আছে তাই তো? তিতলি বলল।
- থাকাটা কী অস্বাভাবিক, বলো?
- তুমিই খুঁজে বের করো, দাদা। অর্নব বলল।
- তোমাদের সাথে দেখা না হলে অন্য উপায়ে বের করতাম, কিন্তু দেখা হয়ে যখন হয়ে গেছে, আর কেন কষ্ট করি বল তো?
- অর্নব, গল্পটি তুমিই দাদাকে বলে দাও এবার।
অর্নব বলতে শুরু করল,
- আমি এখান থেকে DMDC হয়ে ইসলামপুরে জয়েন করার মাস তিনেক পরে আমাদের SDO সাহেব বদলি হয়ে যান, তিনি ADM হয়ে চলে যান, আর সেখানে আসার খবর পাই এক ম্যাডাম আসছেন, IAS হয়ে First Posting। নাম অনিন্দিতা রায়। এই নামটা শুনেই মনের মধ্যে কেমন একটা করে উঠেছিল। কিশোর বয়সের প্রথম ভালোবাসা, নামটাই একটা ভালোবাসা, মানুষ যেই হোক না কেন!
- তখন তোমার মনে হয়নি, তোমার অনিন্দিতা হতে পারে।
- আমার সব অনিন্দিতাকেই নিজের বলে মনে হত, কিন্তু আমার ওর সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ওর বিয়ের পরেই শেষ হয়ে যায়। আমি আর ওর খোঁজ রাখিনি, নিজের জন্য ভাবতে শুরু করেছিলাম।
-তারপর?
- ইসলামপুর অফিসে যেদিন তিতলি জয়েন করতে আসে, আমরা অনান্য যারা ছিলাম, সবাই রীতি অনুযায়ী ওয়েলকাম করতে গিয়েছিলাম...
- আর গিয়ে দেখলে..
- আর গিয়ে দেখি তিতলি!!
- মনে আনন্দ হল?
- না, আনন্দ হয় নি, রাগও হয়নি, আমি ওর সম্বন্ধে নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম, ঠিক যেভাবে অন্যান্যরা আচরন করেছে, আমিও তেমন আচরন করেছি, যেমনটা হয় আর কি, আর তিতলির থেকে SDOর আচরনই পেয়েছি।
- তাহলে এগোলো কে?
- আমি তো জানতামই না যে ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে,, আর যেহেতু ও আমার সিনিয়র, কাজের বাইরে আমি কোনও কথা বলতাম না। কিন্তু ওর চোখে মুখে আলাদা কিছু একটা লক্ষ্য করতাম, বুঝেও উপেক্ষা করতাম। একদিন কিছু একটা কাজে ওর ঘরে যাই, ও একাই ছিল, ও আমাকে আমার ডাকনামে ডেকে বলে,
- কেমন আছিস পাবলো?
আমার ডাক নাম পাবলো, ও আমাকে এই নামেই ডাকত।
- কিছু বলবেন ম্যাডাম?
- আর কতদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখবি?
- সরি ম্যাডাম,
বলে বেড়িয়ে আসতে যাচ্ছিলাম, ও ছুটে এসে হাত ধরে বলে,
- একবার আমার নাম ধরে ডাকনা? কতদিন তোর মুখে আমার নাম শুনিনি!
তিতলি বলল, তুমি কী বলেছিলে সেটা বলো এবার।
- বলছি তো, এখন খুব আগ্রহ, না?
অর্নব আবার বলতে শুরু করল,
আমার প্রথম কথাই ছিল,
- তুই বিয়ে করবি অন্য কোথাও, আমাকে জানাতেই পারতি, তার জন্য কথাবার্তা বন্ধ করে দেওয়ার দরকার ছিল কী? তুই তো জানতিস, তোকে ছাড়া আমি একমুহূর্ত বাঁচতে পারি না, সেই ক্ষমতা আমার ছিল না, কত কষ্ট করে নিজেকে নিজেই সামলেছি। কেউ সাথ দেয় নি। বখে যাওয়া ছিলাম কিনা? আমি কি কখনও তোকে কোনও বিষয়ে জোর করেছি? সব সময় আগলে রেখেছি, তুই যাতে পড়াশোনা করে বড় কিছু হতে পারিস, সেই চেষ্টা করে গেছি, বাবার কাছ থেকে হাতখরচের টাকা নিয়ে তোকে বই কিনে দিয়েছি। বলতে পারবি, একদিনও তোকে কোনও কথায় কষ্ট দিয়েছি? তোকে ভালোবাসি বলে আমার বাবা মা-ও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসেছি, একা, সম্পূর্ন একা।
- পাবলো, �প্লিস চুপ কর, আমি নিরুপায় ছিলাম।
- মিথ্যে কথা, আমি তোকে বিশ্বাস করি না।
- এত সহজে আমার থেকে বিশ্বাস চলে গেল? আগের কথা তোর কী কিচ্ছু মনে নেই?
- আমার সব মনে আছে, তুই ভুলে গেছিস। আর এই পাবলো তোর সেই আগে পাবলো নেই। আজ আর এত সহজে কিছু বিশ্বাস করে না। আমার হাত ছেড়ে দে।
তিতল সে মুহুর্তে অর্নবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে।
এবার তিতলি বলে,
তুমিও তখন নিজেকে আর সামলে রাখতে পারনি, সেটাও বলো, শুধু আমার কথা বললেই হবে?
- হ্যাঁ দাদা, ওনেক দিন পরে ওর ওভাবে হঠাৎ জড়িয়ে ধরা দেখে আমিও নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি, সেদিন দুজনাই একসাথে অনেকক্ষন কেঁদেছিলাম। এভাবেই আমার পুরোনো তিতলিকে ফিরে পেলাম।
তারপরে ওর সাথে অফিসেই কথাবার্তা চলত,
- হ্যাঁ রে পাবলো, তোর মিসেস কি করে?
- কুমার আছি রে, পাগলী, কুমার।
- বলিস কী?
- হ্যাঁ, এবার করব, মা আর একা পারছে না সামলাতে। মা তো এখনো তোর কথা বলে, বলে যে, কীরে, যার জন্য বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরতি, পারলি তাকে ঘরে আনতে?
- তুই কী বললি?
- আমি আর কী বলব? মাথা নীচু করে থাকি। আর মা বলে, ওই মেয়ে চলে যাওয়ায় তুই ভদ্র হয়েছিস। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিস।
- তাহলে আমাকে ক্রেডিট দিচ্ছিস?
- সরাসরি দিচ্ছি না, কিন্তু ঘুরিয়ে দিতেই হয়।
- আজ যদি কাকীমার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, রাগ করবে?
- না মনে হয়, আজ আর তোর ওপর রাগ নেই কারও।
- আমাকে বিয়ে করবি?
- মানে?
- মানে আমাকে বিয়ে করবি?
- তোর সেই সায়ন্তন বসু?
- প্রিপারেশন নেওয়ার সময় কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম, তার পছন্দ হয়নি, সারাদিন লেখাপড়া তার সহ্য হয়নি, আর আমারও একঘেয়ে সংসার সহ্য হয়নি।
- এখন?
- আপাতত দুবছরের ছেলে নিয়ে একাই আছি। মিউচুয়াল ডিভোর্স।
তিতলি বলে,
- তারপরেই আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই। ততদিনে অফিসের সবাই জেনে গেছে আমাদের ব্যাপারটা। একবছর হল, আমরা একসাথে আছি আমাদের ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে।
- আর এই বুঝি সেই ছোট্ট বাবু? কেমন আছো বাবা?
চলুন দাদা, এবার কিছু খেয়ে নেই।
- না গো, আজ উঠি, অন্য কোনওদিন আসব আবার, এতক্ষনে মেয়ে হয়ত কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।
এরপর অর্নবের বাবা মায়ের সাথে দেখা করে ও বিজয়ের প্রনাম করে বিদায় নিলাম।
এমনটাও হয়, ভাবতে ভাবতে বাড়ি এলাম।
(সমাপ্ত)